হস্তশিল্পে নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি
হস্ত সেলাই একটি আর্ট, একটি শিল্প। একজন নকশী শিল্পি তার মনের মাধুরী মিশিয়ে নকশি পণ্য সেলাই করে এবং নিজের মনের ভেতর ঘুরপাক খাওয়া চিত্রগুলো ফুটিয়ে তোলে। প্রতিটা নকশা ফুটিয়ে তোলার পর তারা আত্মতৃপ্তি লাভ করে।
Table of Contents
হস্ত শিল্প কেবল একজন শিল্পির মনের আত্মতৃপ্তিই নয়। এটি তার আনন্দ এবং পেশা। অতীতকালে এটিকে পেশা হিসেবে না নেওয়া হলেও বর্তমানে নকশি পণ্যকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিশাল এক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। তাই বলা যায়, হস্তশিল্পে নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি।
আজকে পানেছারবানুর গল্পের মাধ্যমে আলোচনা করবো যে, কীভাবে হস্তশিল্পে নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি এবং তা কীভাবে শূন্য থেকে বড় হয়। উপন্যাসটি লিখেছেন হাসনাত আব্দুল হাই। গল্পে তিনি অনেকগুলো দিক ফুটিয়ে তোললেও আমি আলোচনা করবো কেবল হস্তশিল্পে নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি নিয়ে।
পানেরছারবানু একজন অশিক্ষিত গ্রামের মহিলা। তিনি খুবই অল্প বয়সের বিয়ে করে স্বামীর সংসার করছেন। এক পুত্র, স্বামী, শ্বাশুড়ি আর কাজের লোকদের নিয়ে বেশ সুখেই কাটছে তার দিন। কিন্তু স্বামী যখন বড় হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি জমায় তখন ঘটে বিপত্তি। সুখী পানেছারের সামনে ভেসে উঠে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ। যার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না পানেছার।
তার রূপ সম্পর্কে সে অবগত থাকলেও তার গুণগুলো সম্পর্কে ছিলেন একদমই বেখেয়ালি। তবে কারো গুণ তো আর লুকানো যায় না, তাই পানেছারের রূপও লুকায়িত ছিল না। তা জেনেছে পানেছারের স্বামী, ছেলে এবং সংগঠন কর্মীরা।
স্বামী ইলিয়াস দেখেছেন তার স্ত্রী সংসারের প্রতি কতটা আন্তরিক এবং দীর্ঘ ১৫-১৬ বছর ধরে কীভাবে তা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পানেছারের ছেলে জেনেছে তার মা কত নিখুঁতভাবে গল্প বলতে জানে এবং গুণ গুণ করে গান গায়। আর সংগঠন কর্মীরা দেখেছে পানেছার কত সুন্দরভাবে নকশিকাঁথা সেলাই করতে জানে এবং স্বামী ছাড়া সংসার সামলায়।
সংগঠন কর্মীরা যখন পানেছারের সেলাই দক্ষতায় পঞ্চমুখ, তখন তিনি লজ্জায় মুখ ডাকেন। কারণ তিনি জানতেন না, নকশিকাঁথা নিজেদের জন্য সেলাই করা ছাড়া বিক্রি করা যায়, তা দিয়ে উপার্জন করা যায়। তিনি এতদিন শুধু ব্যবহারের জন্যে আর নিজের সুখ, দুঃখ ফুটিয়ে তোলবার জন্যই নকশিকাঁথা সেলাই করতেন। আবার এমনটাও বলা যায় একাকীত্বের সময় নিজের মনে পুশে থাকা আবেগ অনুভূতিগুলো ফুটিয়ে তোলার মাধ্যম নকশিকাঁথা।
স্বামী বিদেশের উদ্দেশ্যে বাড়ি ত্যাগ করলে অর্থনৈতিক চাপে পড়েন পানেছার। স্বামীর কোন খুঁজ নাই এবং সামনের দিনগুলোতে কীভাবে সংসার চালাবেন তারও উপায় দেখছেন না পানেছার। এসব ভেবে ভেবে যখন তিনি হতাশ হন, তখনি বাড়িতে আসে দুই জন সংগঠন কর্মী মহিলা। তারা জানান যে, অস্বচ্ছলদের স্বচ্ছল করতে তাদের কর্মসূচী। কিন্তু এতে তেমন আশা দেখতে পাননি পানেছার। যেহেতু তিনি লেখাপড়া তেমন জানেন না তাই কোন উত্তর না দিয়ে সংগঠন কর্মীদের থেকে পাওয়া ফরম রেখেছেন ছেলে আলী আক্কাসের জন্যে।
স্কুল থেকে আলী আক্কাস ফিরলে তার হাতে তোলে দেন সংগঠন কর্মীদের ফরম। আলী আক্কাস তা পড়ে পূরণ করে দেয়। এ নিয়ে আলোচনা এখানেই শেষ। কিন্তু কিছুদিন পর যখন আগের দু‘জনসহ মোট চারজন নারী পুরুষ সংগঠন কর্মী আসে পানেছারের বাড়ি তখনি সংসার এগিয়ে নেওয়ার আশা দেখেন পানেছার। তারা পাশে দাঁড়ানোর আশা দেন, ঋণ দেবার কথা বলেন। সেই সাথে ঋণ পরিশোধ এবং রোজগারের পথ দেখিয়ে দেন। যা একদমই স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হয় পানেছারের। যাদেরকে তিনি চিনেন না, জানেন না, তারা কেন ঋণ দেবে? তারা কেনে তার সেলাই করা নকশিকাঁথা কিনবে? এগুলো কী স্বপ্ন নাকি সত্যিই আশা? তা যদি সত্যি হয় তাহলে বলতে হবে আল্লাহ হাতে ধরে পানেছারের পাশে দাঁড়িয়েছে সংসার এগিয়ে নিতে।
পানেছারের পেশার যাত্রা
আল্লাহর তরফ থেকেই যেন নারী সংগঠনের ছেলেমেয়েরা এসে তাকে সদস্য করে নিয়ে তার তৈরি কাঁথা কিনতে শুরু করেছে। সংগঠন কর্মীদের ক্রয়াদেশের কারণে প্রতিদিন সকাল থেকেই নকশীকাঁথা সেলাই করেন পানেছারবানু। প্রথমে কাঁথাগুলো ছিল আকারে ছোট, সেলাইতে সময় কম লাগে এবং দামও কম।
সংগঠন কর্মীদের থেকেই প্রস্তাব আসে তারা যদি নকশা দেয়, সুই সুতা এবং কাপড় দেয় তাহলে বড় কাঁথা সেলাই করতে পারবে কিনা পানেছার। এতে করে দামও বেশি পাবে এবং চাহিদাও বাড়বে। পানেছারও লুপে নেয় সেই প্রস্তাব এবং সংসারের কাজের পাশাপাশি মনযোগ বাড়ে নকশিকাঁথায়। এখন আর ডানে বামে তাকানোর ফুরসত নেই।
নকশিকাঁথা সেলাই করে যেমন তিনি আত্মতৃপ্তি পান, তেমনি নগদ আয়ও বাড়ছে। যা স্বামী ছাড়া সংসার চালাতে গিয়ে টাকার অভাবে তিনি যখন দিশে হারা তখনি জুটেছে আয়ের পথ। তাই খুবই আনন্দ, আগ্রহ আর আন্তরিকতার সাথে চলে যাচ্ছে পানেছারের দিগুলো।
এখন প্রায় প্রায় মটরসাইকেল নিয়ে কাঁথা নিতে পানেছারের বাড়ি আসে সংগঠন কর্মীরা। তারা দিয়ে যায় সুতা, কাপড় ও নকশা। সংগঠন কর্মীদের থেকে জানতে পারেন পানেছারের কাঁথার প্রসংশা এবং চাহিদা। জানা যায়, তার কাঁথা এখন শুধু রাজধানী ঢাকায় নয়, যায় বিদেশও। এ কথা শুনে চাদের দিকে তাকায় পানেছার। আসলে কী চাঁদ ছোঁয়া যায়? পানেছারের কাঁথা বিদেশ যায়? বিদেশিদের পছন্দ হয়? খুশিতে এমন নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খায় পানেছারের মনে। তাই প্রশ্নগুলো বার বার জিজ্ঞেস করে নিজের একমাত্র ছেলে আলী আক্কাসকে।
পানেছারের হস্তশিল্পের উন্নতি
চাহিদা বাড়ার কারণে পানেছার একার পক্ষে তা পূরণ করা সম্ভব হয় না। তাই সংগঠন কর্মীদের পরামর্শে তিনি গ্রামের অস্বচ্ছল আর আগ্রহী নারীদের একত্রে করতে শুরু করে। তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয় এবং নিজের বাড়িতে বসিয়ে তাদেরকে দিয়েও সেলাই করায়। এভাবে বাড়তে থাকে পানেছারের প্রশিক্ষণার্থীদের সংখ্যা। গ্রামের নারীরাও বাড়িতে বসে আয়ের পথ পেয়ে খুশিতে আত্মহারা।
অশিক্ষিত পানেছার এখন কেবল একজন হস্তশিল্পিই নয়। তিনি একজন প্রশিক্ষক এবং গ্রামের নারীদের লিডার! আবার নিজের সংসারের পরিচালক।
আগের চেয়ে বাড়ছে পানেছারের আয় এবং গ্রামের নারীদের সংখ্যা। তাই সংগঠন কর্মীদের থেকে প্রস্তাব আসে ঋণ নেওয়ার এবং নারী কর্মীদের জন্য একটি ঘর করার। যেখানে থাকবে শুধু চাল এবং চারপাশ খোলা। আবার বন্ধ থাকা হালচাষ শুরুর করার জন্য এক জোড়া চাষের গরু কেনারও প্রস্তাব দেয় সংগঠন কর্মীরা। নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে আলী আক্কাসও তাতে উন্নতি দেখে। তাই পানেছার প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং ১৫ হাজার টাকা লোন পায়। এভাবেই দিন ফিরে পানেছারের।
তিনি হস্ত শিল্প দিয়ে দাঁড়িয়েছেন নিজের পায়ে। তাই জীবনের পরের ধাপে ট্রাজেডি ঘটলেও হস্ত শিল্প ছিল তার অর্থনৈতির সমৃদ্ধি। হয়তো জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত এটিই ছিল তার আয়ের উৎস।
এটি একটি উপন্যাস হলেও এমন গল্প বাংলাদেশে শতশত। আলিয়া’স কালেকশনের মাধ্যমে যশোর অঞ্চলের কিছু নারীর গল্প শূন্য থেকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। তারা সবাই অল্প শিক্ষিত, তারা নারী। কেউ তরুণী আবার কেউ রমণী। কিন্তু তাদের আছে হস্ত শিল্পের দক্ষতা এবং কাজ করার আন্তরিকতা। তারা সুই সুতার মাঝে খুঁজে পায় নিজের আত্মতৃপ্তি। পরম যত্নে তারা ফুটিয়ে তোলে আলিয়া’স কালেকশন থেকে পাওয়া নকশাগুলো। অনেক সময় নিজেদের মনের ভিতর থাকা নকশাও স্থান পায় সুইয়ের ফোঁড়ে ফোড়ে।
আমরা চাই আলিয়া’স কালেকশনের মাধ্যমে এমন গল্প তৈরি হোক হাজার হাজার। তারা আয় করে দাঁড়াক নিজের পায়ে এবং সহযোগিতা করুক নিজের পরিবার ও সমাজকে। আমরা সবসময় সঙ্গী হয়ে থাকবো তাদের স্বপ্ন পূরণে এবং তাদের সুনিপুণ দক্ষতা ও পরম যত্নে শিল্পকর্মগুলো তোলে দেব দেশ বিদেশে থাকা আমাদের ক্রেতাদের হাতে।