সুই সুতায় প্রতিভা

সুই সুতায় প্রতিভা

সুই সুতায় প্রতিভা

ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য স্বামী অবৈধ পথে বিদেশ পাড়ি দিয়েছে। যাওয়ার সময় প্রায় জমিই বিক্রি, বন্ধক বা বর্গা দিয়ে গেছে। গোয়াল ঘরের গরুগুলো চুরি হয়ে গেছে। বাড়িতে অবিভাবক না থাকলে মানুষের লুট-অত্যাচার বেড়ে যায়। অর্থের যোগান যেখানে বন্ধ সেখানে ছেলে, শ্বাশুড়ি এবং চাকর-চাকরানি নিয়ে কেমনে চলবে পানেছারবানুর সংসার?

যশোরের হাতের কাজের শাড়ি

গল্পের সামারি বলা যাক। পানেছারের স্বামী ইলিয়াস আলী এলাকার একজন ভালো লোক। জমিজামা আছে কয়েক বিঘা। গরু, ঘোড়া, চাকর-চাকরানি সবই আছে তাদের। তবে তাকে আরও বেশি বড় হতে হবে। তাই গ্রীসে গিয়ে কঠোর পরিশ্রম করতে পারলে তার স্বপ্ন পূরণ হবে। বাড়িতে দালান উঠবে, জমি বাড়বে, মোটরসাইকেল হবে, মসজিদ মাদ্রাসা ও এলাকার উন্নয়নে হাত খোলে দান খয়রাত করতে পারবে। বৈধ পথে যাওয়ার সুযোগ না থাকায় ১১ জন মিলে পাড়ি জমায় অবৈধ পথে।

অনেক চড়াই উতরাই ও মানবেতর জীববনযাপন করে গ্রীস পৌঁছতে সময় লেগে যায় ২০ মাস। এরমধ্যে সঙ্গী হারায় ৮ জন। তাদের বেশিভাগই মারা পড়েছে আবার কয়েকজন বিভিন্ন দেশে গ্রেফতার হয়েছে। ৩ জনের ভাগ্য ভালো বলতেই হয়। কারণ তারা বেঁচে আছে। গ্রীসে পৌঁছলেও কাজ পাওয়ার আগেই তারা গ্রেফতার হয়ে ১ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হয়। গত ২০ মাসে বাড়িতে বেশ কিছু চিঠি পাঠালেও তা পৌঁছায়নি। আসলে যাদের হাতে চিঠি আর ডাক টিকিটের টাকা আত্মসাৎ করে আর চিঠিগুলো পাঠায়নি। তাদের কারাবরণ শেষ হলে শূন্যহাতে ফিরতে হয়েছে বাড়িতে।

গরু চুরি হয়ে হালচাষ ও জমি আবাদ বন্ধ হয়ে যায় পানেছারবানুর। ক্যাশ টাকাও শেষ হয়ে যায়। আর গ্রামবাসীর জ্বালাতন তো ছিলই। সব মিলিয়ে নিঃস্ব হয়ে সংসার ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম। এমন সময়ই আবির্ভাব হয় এনজিও কর্মীদের। তারা সদস্য করতে চায় নিজেদের সংগঠনে। দিতে চায় ঋণ এবং করতে চায় স্বাবলম্বী। তাদের দৃষ্টি কাড়ে পানেছারের সেলাই করা নকশীকাঁথায়। দেখা দেয় নতুন সম্ভাবনা। উন্মুক্ত হয় আয়ের পথ।

নকশীকাঁথা সেলাই করতে পানেছারকে উৎসাহ দেয় এনজিও কর্মীরা। তারাই বিক্রি করে এবং পানেছারের হাতে ক্যাশ টাকা তোলে দেয়। তা যেন বিশ্বাসই হতে চায় না পানেছারের। হালচাষের গরু কেনার জন্য তাই দেয় ১৫ হাজার টাকার ঋণ। স্বামী ছাড়া সংসারে আবারও শুরু হয় হালচাষ জমি আবাদ। বলে রাখা ভালো লেখাপড়ার হাতে খড়ি হয়নি পানেছারের। ছেলে ক্লাস নাইন নাকি টেনে পড়ে তাও জানে না পানেছার। শুধু জানে বড় ক্লাসে পড়ে তার ছেলে আলী আক্কাস।

যশোরের হাতে সেলাই শাল
যশোরের হাতে সেলাই শাল

লেখাপড়া ও স্বামী ছাড়া সংসার অর্থনৈতিক বিপ্লব করে পানেছার। সেই সাথে গ্রামের অন্য নারীদেরও কর্মসংস্থান করেন নকশীকাঁথার সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে। তারা এখন কাজ করে পানেছারের অধীনে। তিনি এখন কেবল লেখাপড়া না-জানা নারীই নয়। বরণ গ্রামের নারীদের অর্থনৈতিক উন্নয় লিডারও।

স্বামীর খবর হওয়ার আগেই নকশীকাঁথা সেলাই করে ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায় পানেছারের। স্বামী দেশে ফিরে দেখে যেখানে পরিবারের সদস্যদের না খেতে পারার কষ্টে থাকার কথা সেখানে তারা চলছে স্বাচ্ছন্ধ্যে।

আমাদের দেশের নারীরা এভাবেই অবদান রাখে নিজের পরিবার, সমাজ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের। কেবল তাদের হাতটা ধরতে হয়, একটু সাহায্য করতে হয়। তাহলে তারা নিজেদের সুপ্ত প্রতিভাগুলো মেলে ধরার সুযোগ পায় সর্বত্র। তাদের রয়েছে লোকশিল্পের দক্ষতা, কাজ করার আগ্রহ ও আন্তরিকতা। তারাও চায় ভাগ্য পরিবর্তনে অবদান রাখতে। যশোর, জামালপুরসহ দেশের বিভিন্ন দেশে এমন হাজার হাজার পানেছারবানু রয়েছে।

জেনিস ফারজানা তানিয়া
জেনিস ফারজানা তানিয়া, স্বত্বাধিকারী: আলিয়াস কালেকশন

যশোরের অনেক তরুণী ও নারীরা এভাবে গল্পের অংশ হয়ে যাচ্ছে আলিয়া’স কালেকশনের মাধ্যমে। সুই সুতায় প্রতিভা ফুটিয়ে তোলার সুযোগ করে দিয়েছে আলিয়া’স কালেকশনের স্বত্বাধিকারী জেনিস ফারজানা তানিয়া। তিনি সমাজের পিছিয়ে থাকা কিছু নারীর ভাগ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে তাদের হাত শক্ত করতে উদ্যোগ নিয়েছেন আলিয়াস কালেকশনের।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top